ইসলামী জীবন (Islamic Life) ব্যবস্থায় যাকাতের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অনেক। এটি ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদত। সকল সচ্ছল ধনী মুসলিমের উপর মহান আল্লাহ যাকাতকে ফরয করেছেন। বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে যাকাত মুসলিমদের উপর ফরয। নিম্নে যাকাত, যাকাতের প্রদানকারীর শর্ত ও যোগ্যতা, যাকাত গ্রহনকারীর বর্ণনা এবং বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এর সুফল সমূহ আলোচিত হল।
'যাকাত' আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ - বৃদ্ধি, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় ধনী ব্যক্তিদের নিসাব (নির্ধারিত) পরিমাণ সম্পদ থাকলে নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও অভাবী লোকদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়াকে যাকাত বলে।
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ ব্যক্তিবিশেষের হাতে পুঞ্জীভুত থাকে না। আর মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকুক আল্লাহ তায়ালা তা পছন্দ করেন না। তিনি চান সম্পদ মানুষের কল্যাণে ব্যয় হোক, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হোক। এ বিবেচনায় যাকাত অর্থ বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানে দাতার অন্তর কৃপণতার কলুষ থেকে পবিত্র হয়। বিত্তশালীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার আছে। কাজেই গরিবের নির্ধারিত অংশ দিয়ে দিলে অবশিষ্ট সম্পদ ধনীদের জন্য পবিত্র হয়ে যায়। এদিক বিবেচনায় যাকাত অর্থ পবিত্রতা। যাকাত দিলে সম্পদে আল্লাহ বরকত দান করেন।
ইসলামে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের মধ্যে যাকাত অন্যতম। কুরআন মজিদের বহু জায়গায় সালাতের সাথে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ أَنَّكَ تَقُومُ أَدْنَىٰ مِنْ ثُلُثَيِ اللَّيْلِ وَنِصْفَهُ وَثُلُثَهُ وَطَائِفَةٌ مِنَ الَّذِينَ مَعَكَ ۚ وَاللَّهُ يُقَدِّرُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ۚ عَلِمَ أَنْ لَنْ تُحْصُوهُ فَتَابَ عَلَيْكُمْ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ۚ عَلِمَ أَنْ سَيَكُونُ مِنْكُمْ مَرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ ۚ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا ۚ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
অর্থঃ "তোমার প্রভু অবশ্য জানেন যে তুমি তো জেগে থাক রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, আর তার অর্ধেক আর তার এক-তৃতীয়াংশ, আর তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদের একটি দলও। আর আল্লাহ্ রাত ও দিনের পরিমাপ রক্ষা করেন। তিনি জানেন যে তোমরা কখনো এর হিসাব রাখতে পারবে না, কাজেই তিনি তোমাদের দিকে ফিরেছেন, সেজন্য কুরআন থেকে যতটা তোমাদের জন্য সহজ ততটা আবৃত্তি করো। তিনি জানেন যে তোমাদের কেউ-কেউ রোগগ্রস্ত হবে এবং অন্যেরা দুনিয়াতে চষে বেড়াবে আল্লাহ্র করুণাভান্ডারের সন্ধানে, আর অন্যান্যরা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করবে, সেজন্য এ-থেকে যতটা তোমরা সহজ মনে কর ততটা আবৃত্তি করো, আর নামায কায়েম রেখো ও যাকাত আদায় করো এবং আল্লাহ্কে ঋণদান করো উত্তম ঋণ। আর যা কিছু সৎকাজ তোমরা নিজেদের জন্য আগবাড়াও তা তোমরা আল্লাহ্র কাছে পাবে, -- সেটিই বেশি ভাল ও বিরাট প্রতিদান। আর আল্লাহ্র কাছে পরিত্রাণ খোঁজো, নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ পরিত্রাণকারী, অফুরন্ত ফলদাতা।" - সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত -২০
যাকাত হল দরিদ্রের আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার। ধনীদের দয়া বা অনুগ্রহ নয়। বরং এটি আদায় করা ধনীদের উপর ফরজ। এ প্রসজ্ঞে আল্লাহ তায়ালা বলেন -
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
অর্থঃ "তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।" -সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৯
শরিয়তের বিধান অনুযায়ী নামায আদায় করলে, আদায়কারীর জন্য যেমন পুরষ্কারের ঘোষণা আছে, তেমনি যাকাত (ফরজ হলে) আদায়কারীর জন্যও সুসংবাদ রয়েছে। যেমন, যাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং সম্পদে আল্লাহ তায়ালা বরকত দেন। যাকাত প্রদানকারীর আখিরাতে অধিক পরিমাণ পুরষ্কার দেওয়া হবে যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। হাদিসে কুদসিতে আছে, "আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে বলেন, হে বনি আদম! আমার পথে খরচ করতে থাক। আমি আমার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে তোমাদের দিতে থাকব" - বুখারি ও মুসলিম।
যাকাত আদায়কারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন -
وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا ۖ وَقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ ۖ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآمَنْتُمْ بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۚ فَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ
অর্থঃ "আর আল্লাহ্ অবশ্যই ইসরাইলের বংশধর থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, আর আমরা তাদের মধ্যে থেকে বারো জন দলপতি দাঁড় করিয়েছিলাম। আর আল্লাহ্ বলেছিলেন -- ''নিঃসন্দেহ আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি। যদি তোমরা নামায কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো, আর আমার রসূলদের প্রতি ঈমান আনো ও তাঁদের সমর্থন করো, আর আল্লাহ্কে ধার দাও পর্যাপ্ত-সুন্দর ঋণ, তবে আমি নিশ্চয়ই তোমাদের থেকে তোমাদের সব পাপ মোছে দেব ও তোমাদের প্রবেশ করাবো উদ্যানসমূহে যাদের নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনারাজি। কিন্তু এর পরে তোমাদের মধ্যের যে কেউ অবিশ্বাস পোষণ করবে সে-ই তবে নিশ্চয়ই সরল পথের দিশা হারিয়েছে।’’" - সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ১২।
যাকাত দানকারীর পুরষ্কার ও কৃপণ ব্যক্তির দূঃসংবাদ সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে আছে, "দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী। অপরদিকে কৃপণ আল্লাহ থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের নিকটে। একজন জাহিল দানশীল একজন কৃপণ আবিদ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি পছন্দনীয়।" - তিরমিযি।
কেউ যদি সম্পদ জমা করে রাখে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে -
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
অর্থঃ "ওহে যারা ঈমান এনেছ! নিঃসন্দেহ পন্ডিতদের ও সন্ন্যাসীদের মধ্যের অনেকে লোকের ধনসম্পত্তি অন্যায়ভাবে গলাধঃকরণ করে আর আল্লাহ্র পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে। বস্তুতঃ যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে অথচ আল্লাহ্র পথে খরচ করে না, তাদের তাহলে সংবাদ দাও মর্মন্তুদ শাস্তির।"
يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
অর্থঃ "যেদিন এগুলো উত্তপ্ত করা হবে জাহান্নামের আগুনে, তারপর তা দিয়ে দেগে দেয়া হবে তাদের কপালে ও তাদের পার্শ্বদেশে ও তাদের পিঠে। ''এটিই সেই যা তোমরা জড়ো করেছিলে, অতএব আস্বাদন করো যা তোমরা জমিয়েছিলে!’।"
- সূরা আততাওবা- ৩৪-৩৫।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলে কিছু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করল। খলিফা তাদের ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সমতুল্য মনে করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, মহানবি (সাঃ) এর যুগে যারা যাকাত দিত, তাদের মধ্যে কেউ যদি একটি ছাগলের বাচ্চা দিতেও অস্বীকার করে তবে তাঁর বিরুদ্ধে আমি জিগাদ করব। হযরত আবু বকর (রাঃ) এর বক্তব্যের যৌক্তিকতার সাথে নিম্নবর্ণিত হাদিসের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। হাদিসে আছে,
অর্থঃ "আল্লাহর কসম, যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই করব।" - বুখারী।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তঃ
যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত ৭ (সাত) টি । শর্তগুলির বিবরন নিচে দেওয়া হল -
১। মুসলমান হওয়াঃ
যাকাত ফরয হওয়ার প্রথম শর্ত হল মসলমান হওয়া। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ নয়। কাজেই কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে তাঁর অতীত জীবনের যাকাত দিতে হবে না। যেদিন মুসলমান হবে সিদিন থেকে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
২। নিসাবের মালিক হওয়াঃ
যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে শরিয়তে যাকাত ফরজ হয়, সে পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
৩। নিসাব পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়াঃ
যেসব দ্রব্যের উপর মানুষের জীবনযাপন নির্ভর করে, সেসব জিনিসপত্রকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বলে। যেমন, খাওয়া-দাওয়া , পোশাক-পরিচ্ছদ, বসবাসের বাড়িঘর, পেশাজীবীর যত্রপাতি ইত্যাদি। যানবাহনের নৌকা, সাইকেল, মোটর, পশু, কৃষিকাজের সরঞ্জাম, পড়ালেখার সরঞ্জাম এসবও প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর উপর যাকাত ফরজ হবে না।
৪। ঋণগ্রস্ত না হওয়াঃ
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাঁর উপর যাকাত ফরজ হবে না। কারণ সে জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনেই ঋণ গ্রহন করেছে। তবে ঋণ পরিশোধ করার পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ কারো হাতে থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে।
৫। মাল এক বছরকাল স্থায়ী থাকাঃ
নিসাব পরিমাণ সম্পদ ব্যক্তির হাতে এক বছর কাল স্থায়ী না হলে, তাঁর উপর যাকাত ফরজ হয় না। হাদিসে আছে, "ঐ সম্পদে যাকাত নেই যা পূর্ণ এক বছর মালিকানায় না থাকে।" - ইবনে মাজাহ।
৬। জ্ঞানসম্পন্ন হওয়াঃ
যাকাত ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। জ্ঞানবুদ্ধিহীন তথা পাগলের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৭। বালেগ হওয়াঃ
যাকাতদাতাকে অবশ্যই বালেগ তথা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হতে হবে। শিশু, নাবালেগ যত সম্পদের মালিকই হোক না কেন, বালেগ হওয়ার পূর্বে তাঁর উপর যাকাত ফরজ হয় না।
যাকাতের নিসাবঃ
'নিসাব' আরবি শব্দ। এর অর্থ নির্ধারিত পরিমাণ। শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের নির্ধারিত পরিমাণকে নিসাব বলে। সারাবছর জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর বছর শেষে যার হাতে নিসাব পরিমাণ সম্পদ উদবৃত্ত থাকে তাকে বলা হয় সাহিবে নিসাব বা নিসাবের মালিক। আর সাহিবে নিসাবের উপরই যাকাত ফরজ হয়। নিসাবের পরিমাণ হল, সোনা কমপক্ষে সাড়ে সাট তোলা অথবা রুপা কমপক্ষে সাড়ে বায়ান্ন তোলা অথবা ঐ মূল্যের অর্থ বা সম্পদ। ঐ পরিমাণ সম্পদ কারো নিকট পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী থাকলে ঐ সোনা, রুপা বা সম্পদের মূল্যের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দেওয়া ফরয। কারো হাতে যদি বছরের প্রথমে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে, বছরের মাঝে কোন কারণে নিসাব হতে কমে যায় এবং বছর শেষে আবার নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে তাকে যাকাত দিতে হবে।
স্ত্রীলোকের ব্যবহার্য সোনা, রুপার অলংকার জীবনের অবশ্যকীয় মৌলিক বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়। কাজেই অলংকার নিসাব পরিমাণ হলে তাকে যাকাত দিতে হবে। সোনা, রুপা ব্যতীত অন্য কোন ধাতু যথা- তামা, কাঁসা, পিতল ইত্যাদি ব্যবহার্য জিনিস হিসাবে থাকলে যাকাত দিতে হবে না। তবে ব্যবসায়ের সামগ্রী হলে যাকাত দিতে হবে। এর জন্য শর্ত হচ্ছে এসব সামগ্রী এক বছর কাল হাতে স্থায়ী থাকা এবং নিসাব পরিমাণ হওয়া।
উৎপন্ন শস্যের যাকাতঃ
ধান, গম, যব, খেজুর ইত্যাদি শস্য সেচ প্রদান ছাড়া বৃষ্টির পানিতে জন্মালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হবে। একে উশর বলা হয়। আর সেচ ব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত প্রদানের খাত বা মাসারিফঃ
মাসারিফ আরবি শব্দ। এর অর্থ ব্যয় করার খাত। শরিয়তের পরিভাষায় ইসলামি বিধান অনুযায়ী যাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়, তাদেরকে বলা হয় যাকাতের মাসারিফ। যাকাতের মাসারিফ অর্থাৎ কোন কোন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হবে আল্লাহ তায়ালা সয়ং তা নির্ধারন করে দিয়েছে। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে -
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
অর্থঃ "দান তো কেবল অক্ষমদের জন্য, আর অভাবগ্রস্তদের, আর এর জন্য নিযুক্ত কর্মচারীদের, আর যাদের হৃদয় ঝোঁকোনো হয় তাদের, আর দাস-মুক্তির, আর ঋণগ্রস্তদের, আর আল্লাহ্র পথে, আর পর্যটকদের জন্য, -- আল্লাহ্র তরফ থেকে এই বিধান। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞাতা, পরমজ্ঞানী।" - সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৬০
যাকাতের মাসারিফ ৮ (আট) টিঃ
১। অভাবগ্রস্থ বা ফকির।
২। সম্বলহীন, মিসকিন।
৩। যাকাতের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীবৃন্দ।
৪। মন জয় করার উদ্দেশ্যে।
৫। মুক্তিকামী দাস।
৬। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি।
৭। আল্লাহর পথে অর্থাৎ ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৮। মুসাফির বা অসহায় প্রবাসী পথিক।
যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
ইসলামি জীবন (Islamic Life) ব্যবস্থা যাকত ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত থাকলে, সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হবে। আবার ধনীরাও তাদের দায়মুক্ত হওয়ার বিশেষ সুযোগ পাবে। কাজেই ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অনেক। নিম্নে যাকাতের কতিপয় গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হল -
১। যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
যাকাতের অন্যতম গুরুত্ব হল অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। সমাজের কেউ সম্পদের পাহাড় গড়বে, সুউচ্চ ইমারতে বসবাস করবে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে, আর কেউ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাবে এমন বিধান ইসলামে নেই। কেউ শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, আর বাড়ি বারী ঘুরবে, শান্তি ও সম্যের ধর্ম ইসলাম তা কিছুতেই সমর্থন করে না। কাজেই সকল শ্রেনীর নাগরিকের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইসলাম ধনীদের উপর যাকাত ফরজ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, "আল্লাহ তায়ালা লোকের উপর সদকা (যাকাত) ফরয করেছেন। তা নেওয়া হবে ধনীদের থেকে এবং বিলিয়ে দেওয়া হবে দুস্থদের মধ্যে।" - বুখারী ও মুসলিম।
সাধারন মানুষের অর্থের প্রতি লিপ্সা থাকে। যে কৃপণ স্বভাবের হয়, সে নিজেই কষ্টে উপার্জিত অর্থ নিঃস্বার্থভাবে কাউকে দিতে চায় না। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা সম্পদশালী ব্যক্তিদের মনকে সম্পদের লিপ্সা, লোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি দোষ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মানুষের মনকে দয়া-মায়া, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা ইত্যাদি মানবিক গুনসম্পন্ন করে তোলার জন্য তাদের উপর যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন।
সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। মানুষের নিকট তা আমানতস্বরুপ। মানুষ শ্রম ও মেধার দ্বারা সম্পদ অর্জন করবে এবং প্রয়োজন মোতাবেক সম্পদ খরচ করবে। কিন্তু সম্পদ জমা করে রাখা বা কেবল নিজের ভোগবিলাসের জন্য খরচ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার আছে, তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। গরিবের অধিকার আদায় করলে মালিক দয়ামুক্ত হবে, সম্পদ পবিত্র হবে; অন্যথায় সম্পদ হালাল হবে না। ইসলামি অর্থনীতিতে পুজিবাদ সমর্থন করা হয় না। যাকাত প্রথার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
২। যাকাতের সামাজিক গুরুত্বঃ
যাকাতের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বিরজমান বৈষম্য দূর হয়। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আল্লাহর নির্দেশমতো যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করলে সমাজের কোন লোক অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন থাকবে না। কেউ না খেয়ে থাকবে না। কেউ বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবে না।
সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যাকাত ও সাদাকার (দানের) অর্থে অভাবীদের প্রয়োজন মিটিয়েও অনেক জনহিতকর এবং কল্যানমূলক কাজ করা যায়। বহু দরিদ্র ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। স্বাস্থ্যবান দরিদ্র শ্রমিককে তাঁর শ্রমের উপযোগী উপকরণ দেওয়া সম্ভব হয়। দরিদ্রের জন্য সেবামূলক অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন ইয়াতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপন করা যায়।