ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। মানুষের সকল কাজই নিয়তের সহিত সংশ্লিষ্ট। নিয়ত বা উদ্দেশ্য (Vision) ছাড়া মানষ কোন কাজ করে না। কাজের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব কে উপলব্ধি করার জন্য সহীহ বুখারির সর্বপ্রথমে একটি হাদিস বর্নিত হয়েছে। একটি কোম্পানী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যেমন ভিশন এবং মিশন নির্ধারন করতে হয় ঠিক তেমনি মানুষ যখন কোন কাজ মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে করে তখন তাঁর পূর্ব নির্ধারিত নিয়ত করে নিতে হয়। আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে কোন কাজ শুরুতে স্বীকারোক্তি প্রদান করাকে নিয়ত বলা হয়। ইসলামের প্রতিটি কাজেই নিয়তের ভূমিকা অপরিসীম। কিছু কিছু এবাদতের পূর্বে তা বাঞ্ছনীয়।
انامل امل بن نيات
অর্থঃ প্রকৃতপক্ষে সকল কাজ (এর ফলাফল) নিয়তের উপর নির্ভরশীল। - বুখারী
ব্যাখ্যাঃ
আল্লাহ তায়ালা পরকালে সকল মানুষের দুনিয়াতে করা সকল কর্মকান্ডের হিসাব নেবেন। সেদিন তিনি মানুষের সকল কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন। মানুষ যদি সৎ উদ্দেহস্যে কোন কাজ করে তবে সে তাঁর পুরষ্কার লাভ করবে। নেক নিয়তে কাজ করে ব্যর্থ হলেও সে তাঁর জন্য পুরষ্কার পাবে। আর যদি মন্দ বা খারাপ উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে তবে সে শাস্তি ভোগ করবে। এমনকি খারাপ উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে কিংবা ভালো কাজ করলেও তাতে কোন সওয়াব হয় না। বরং নিয়ত সঠিক না হওয়ায় সে ভালো কাজও মন্দ হিসেবে পরিগনিত হয়।
উপরে বর্ণিত হাদিসটির শেষাংশ জানলে আমরা নিয়তের বিশুদ্ধতার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট্রুপে বুঝতে পাবর। এ হাদিসের শেষাংশে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিয়তে হিজরত করে তবে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি লাভ করবে। আর যদি সে পার্থিব লাভ বা কোনো স্ত্রীলোককে বিয়ে করার জন্য হিজরত করে তবে সে শুধু তাই লাভ করবে, সে জন্য সে হিজরত করেছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে এ হাদিসটি বর্ননা করেন। আর তা হলো উম্মে কায়স নামক একজন মহিলা ইসলাম গ্রহন করে মদিনায় হিজরত করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করার জন্য মদিনায় হিজরত করে চলে আসেন। ঐ ব্যক্তির উদ্দেহস্য জানতে পেরে নবি (সাঃ) এ হাদিসটি বর্ননা করেন। যার মূল বক্তব্য হলো - আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করা করা অত্যন্ত পুন্যময় কাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকায় লোকটি হিজরতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলেন।
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস সমূহঃ
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস-১ঃ
وعن أمير المؤمنين أبي حفص عمر بن الخطاب بن نفيل بن عبد العزى بن رياح بن قرط بن رزاح بن عدى بن لؤى ابن غالب القرشى العدوى. رضي الله عنه، قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: " إنما الأعمال بالنيات، وإنما لكل امرىء ما نوى فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هجرته لدنيا يصيبها، أو امرأة ينكحها فهجرته إلى ما هاجر إليه" (متفق على صحته. رواه إماما المحدثين: أبو الحسين مسلم بن الحجاج بن مسلم القشيرى النيسابورى رضي الله عنهما في صحيحهما اللذين هما أصح الكتب المصنفة).
‘আলক্বামাহ ইব্নু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আমি ‘উমর ইব্নুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ কাজ (এর প্রাপ্য হবে) নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে ইহকাল লাভের অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে- তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে, যে জন্যে, সে হিজরত করেছে। [মুসলিম ২৩/৪৫]
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস -২ঃ
وعن أم المؤمنين أم عبد الله عائشة رضي الله عنها قالت: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : "يغزو جيش الكعبة فإذا كانوا ببيداء من الأرض يخسف بأولهم وآخرهم". قالت: قلت: يارسول الله، كيف يخسف بأولهم وآخرهم وفيهم أسواقهم ومن ليس منهم!؟ قال: "يخسف بأولهم وآخرهم، ثم يبعثون على نياتهم" (متفق عليه. هذا لفظ البخاري).
উম্মুল মু’মেনীন উম্মে আব্দুল্লাহ আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘একটি বাহিনী কা‘বা ঘরের উপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বের হবে। অতঃপর যখন তারা সমতল মরুপ্রান্তরে (বাইদা) পৌঁছবে তখন তাদের প্রথম ও শেষ ব্যক্তি সকলকেই যমীনে ধসিয়ে দেওয়া হবে। তিনি (আয়েশা) বলেন যে, আমি (এ কথা শুনে) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কেমন করে তাদের প্রথম ও শেষ সকলকে ধসিয়ে দেওয়া হবে? অথচ তাদের মধ্যে তাদের বাজারের ব্যবসায়ী এবং এমন লোক থাকবে, যারা তাদের (আক্রমণকারীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি বললেন, তাদের প্রথম ও শেষ সকলকে ধসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাদেরকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।’’[১]
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস-৩ঃ
وعن عائشة رضي الله عنها قالت قال النبي صلى الله عليه وسلم: " لا هجرة بعد الفتح، ولكن جهاد ونية، وإذا استفرتم فانفروا" (متفق عليه).
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মক্কা বিজয়ের পর (মক্কা থেকে) হিজরত নেই; বরং বাকী রয়েছে জিহাদ ও নিয়ত। সুতরাং যদি তোমাদেরকে জিহাদের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তাহলে তোমরা (জিহাদে) বেরিয়ে পড়।’’[১]
‘মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই’ এর অর্থ এই যে, মক্কা এখন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হল। ফলে এখান থেকে মুসলিমরা আর হিজরত করতে পারবে না।
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস-৪ঃ
وعن أبي يزيد معن بن يزيد بن الأخنس رضي الله عنهم، وهو وأبوه وجده صحابيون، قال: كان أبي يزيد أخرج دنانير يتصدق بها فوضعها عند رجل في المسجد فجئت فأخذتها فأتيته بها، فقال: والله ما إياك أردت، فخاصمته إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: " لك ما نويت يا يزيد، ولك ما أخذت يامعن" (رواه البخاري).
আবূ ইয়াযীদ মা‘ন ইবনু ইয়াযীদ ইবনু আখনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আবূ ইয়াযীদ মা‘ন ইবনু ইয়াযীদ ইবনু আখনাস (রাঃ) - তিনি (মা‘ন) এবং তাঁর পিতা ও দাদা সকলেই সাহাবী---তিনি বলেন, আমার পিতা ইয়াযীদ দান করার জন্য কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন। অতঃপর তিনি সেগুলি (দান করতে) মসজিদে একটি লোককে দায়িত্ব দিলেন। আমি (মসজিদে) এসে তার কাছ থেকে (অন্যান্য ভিক্ষুকের মত) তা নিয়ে নিলাম এবং তা নিয়ে বাড়ী এলাম। (যখন আমার পিতা এ ব্যাপারে অবগত হলেন তখন) বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাকে দেওয়ার নিয়ত আমার ছিল না। (ফলে এগুলি আমার জন্য হালাল হবে কি না তা জানার উদ্দেশ্যে) আমি আমার পিতাকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, ‘‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সেই বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ এবং হে মা’ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল।’’[১]
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস-৫ঃ
وعن أبي العباس عبد الله بن عباس بن عبد المطلب رضي الله عنهما، عن رسول الله، صلى الله عليه وسلم، فيما يروى عن ربه، تبارك وتعالى قال: " إن الله كتب الحسنات والسيئات ثم بين ذلك: فمن همّ بحسنة فلم يعملها كتبها الله تبارك وتعالى عنده حسنة كاملة، وإن هم بها فعملها كتبها الله عشر حسنات إلى سبعمائه ضعف إلى أضعاف كثيرة، وإن هم بسيئة فلم يعملها كتبها الله عنده حسنة كاملة، وإن همّ بها فعملها كتبها الله سيئة واحدة " (متفق عليه).
আবূল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বরকতময় মহান প্রভু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন যে, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ পুণ্যসমূহ ও পাপসমূহ লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার ব্যাখ্যাও করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি কোনো নেকী করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত করতে পারে না, আল্লাহ তাবারাকা অতা‘আলা তার জন্য (কেবল নিয়ত করার বিনিময়ে) একটি পূর্ণ নেকী লিখে দেন।
আর সে যদি সংকল্প করার পর কাজটি করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তার বিনিময়ে দশ থেকে সাতশ গুণ, বরং তার চেয়েও অনেক গুণ নেকী লিখে দেন। পক্ষান্তরে যদি সে একটি পাপ করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট একটি পূর্ণ নেকী হিসাবে লিখে দেন। আর সে যদি সংকল্প করার পর ঐ পাপ কাজ করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ মাত্র একটি পাপ লিপিবদ্ধ করেন।’’[১]
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস - ৬ঃ
من قام ليلة العيد . وفي لفظ : من أحياها محتسبًا لم يمت قلبه يوم تموت القلوب .
বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিতঃ
“যে ঈদের রাত জাগ্রত থাকে” অন্য বর্ণনায় আছে, “যে ব্যক্তি ঈদের রাত সওয়াবের নিয়তে জাগ্রত থাকে, তার অন্তর মারা যাবে না, যে দিন সকল অন্তর মারা যাবে।”
ইব্ন মাজাহ, এ হাদিস দুর্বল।
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস-৭ঃ
وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : " يقول الله تعالى : ما لعبدي المؤمن عندي جزاء إذا قبضت صفيه من أهل الدنيا ثم احتسبه إلا الجنة" (رواه البخاري).
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার মু’মিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ব্যতীত অন্য কোন পুরস্কার নেই, যখন আমি তার দুনিয়ার প্রিয়তম কাউকে কেড়ে নই এবং সে সওয়াবের নিয়তে সবর করে।’’[১]
নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস - ৮ঃ
وعن عائشة رضي الله عنها أنها سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الطاعون، فأخبرها أنه كان عذاباً يبعثه الله تعالى على من يشاء، فجعله الله تعالى رحمة للمؤمنين، فليس من عبد يقع في الطاعون فيمكث في بلده صابراً محتسباً يعلم أنه لا يصيبه إلا ما كتب الله له إلا كان له مثل أجر الشهيد" (رواه البخاري).
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ
তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি তাঁকে বললেন যে, ‘‘এটা আযাব; আল্লাহ তা‘আলা যার প্রতি ইচ্ছা করেন এটা প্রেরণ করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা একে মু’মিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দিলেন। ফলে (এখন) যে ব্যক্তি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হবে এবং সে নিজ দেশে ধৈর্য সহকারে নেকীর নিয়তে অবস্থান করবে, সে জানবে যে, তাকে তাই পৌঁছবে যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য লিখে দিয়েছেন, তাহলে সে ব্যক্তির জন্য শহীদের মত পুরস্কার রয়েছে।” [১]
শিক্ষাঃ
- নামাজের আগে নিয়ত করা কি?
- নিয়তের ভাষা কি আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন?
- নামাজের নিয়ত কি শুধু আরবীতেই করা যায় নাকি অন্য ভাষা ব্যবহার করা যায়?
- নিয়ত পরবর্তী কাজটি সম্পূর্ন না করতে পারলে তাঁর বিধান কি?
- কোন কাজের নিয়ত পরিবর্তন করা কি যাবে?
- যে কোন কাজের ক্ষেত্রে নিয়ত করা কি আবশ্যক?
- কুরবানির নিয়ত কোন ধরনের এবাদত?
- রোযার নিয়ত কি ফরয?
- আকিকার নিয়ত করা কি?
- ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নিয়তের ভূমিকা কি?
0 মন্তব্য বা কমেন্টস