সাওম বা রোযার নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব

By Islam Hossain - April 21, 2021

সাওম আরবি শব্দ । এর ফারসি প্রতিশব্দ হলো রোযা । এর আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা । ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সাওম হলো-সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সাথে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা । 

প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নারী ও পুরুষের উপর রমযান মাসের এক মাস সাওম পালন করা ফরজ । এটি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাওমের শিক্ষা ও গুরুত্ব অপরিসীম ।


সাওম বা রোযার নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব-Islamic Life



সাওমের নৈতিক শিক্ষা

সাওম কেবল আমাদের উপরই ফরজ নয় । বরং পূর্বের সকল নবি-রাসুলের উম্মতের উপরও ফরজ ছিল । এর মাধ্যমে সাওম পালনকারী আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয় । সাওমের মাধ্যমে মানুষের মনে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও ভয়ে কিছুই পানাহার করে না ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি লাভ করে না । 

মহান আল্লাহ বলেন-

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থ: "তোমাদের উপর সাওম (রোযা) ফরজ করা হয়েছে । যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর । যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পার ।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৩)

আমরা তাকওয়া অর্জনের জন্য রমযান মাসে সিয়াম পালন করব ।

মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোদ-ক্ষোভ ও কামভাবের বশবর্তী হয়ে অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয় । সাওম মানুষকে এসব কাজ থেকে মুক্ত থাকতে শেখায় । সাওম হলো কোনো  ব্যক্তি ও তার মন্দ কাজের মাঝে ঢাল স্বরূপ । মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন-

حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى أَخْبَرَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ عَنْ ابْنِ جُرَيْجٍ قَالَ أَخْبَرَنِي عَطَاءٌ عَنْ أَبِي صَالِحٍ الزَّيَّاتِ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ اللهُ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত [সহিহ বুখারী-১৯০৪]  

তিনি বলেন, আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন, সওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সায়িম। যার কবজায় মুহাম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহ্‌র নিকট মিস্‌কের গন্ধের চাইতেও সুগন্ধি। সায়িমের জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাঁকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।

সর্বোপরি সাওম পালনের মাধ্যমে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জিত হয় ।


সাওমের সামাজিক শিক্ষা

সিয়াম সাধনের ফলে সমাজের লোকদের মাঝে পারস্পারিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয় । সাওম পালন করে এরূপ ব্যক্তি ক্ষুধার্ত থাকার ফলে সে অন্য আরেকজন অনাহারীর ক্ষুধার জ্বালা সহজে বুঝতে পারে । ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা যে কীরূপ পীড়াদায়ক হতে পারে তা সে উপলব্ধি করতে পারে । এতে অসহায় নিরন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার ভাব জাগ্রত হয় । মাহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন,"এ মাস সহানুভুতির মাস ।" [ইবনে খুযায়মা]

রমযান মাসে রাসুলুল্লাহ (স.) অন্যদের দান-সদকা করতে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছেন, তিনি নিজেও তেমনিভাবে খুব দান-সদকা করতেন । হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, "রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন লোকদের মধ্যে অধিক দানশীল ছিলেন । বিশেষ করে রমযান এলে তার দানশীলতা আরও বেড়ে যেত ।" (বুখারি ও মুসলিম)। সাওম অসহায় ও দরিদ্রকে দান করতে উদ্বুদ্ধ করে ।


সাওমের ধর্মীয় গুরুত্ব

ধর্মীয় দিক থেকেও সাওমের অনেক গুরুত্ব রয়েছে । সকল সৎকাজের প্রতিদান আল্লাহ দশগুণ থেকে সাতশত গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবেন । কিন্তু সাওম এর প্রতিদান সম্পর্কে হাদিস কুদসিতে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন-

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ مَسْلَمَةَ عَنْ مَالِكٍ عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنْ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ الصِّيَامُ جُنَّةٌ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَجْهَلْ وَإِنْ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ مَرَّتَيْنِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ تَعَالَى مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي الصِّيَامُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ [সহিহ হাদিস, বুখারী- হাদিস নম্বরঃ ১৮৯৪ ] 

আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সওম পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ্‌র নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ।

এটি একটি মৌলিক ফরজ কাজ । যদি কেউ তা অস্বীকার করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে ।


সাওমের সামাজিক গুরুত্ব

সাওম পালনের মাধ্যমে একজন লোক ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলদ্ধি করতে পারে । সমাজের নিরন্ন ও অভাবীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাস করতে পারে । সাওম (রোযা) পালনকারী ব্যক্তি অন্নায়-অশ্লীল কথাবার্তা পরিহার করে চলে । হানাহানি থেকে দূরে থাকে । ফলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে । অধিক সাওয়াব পাওয়ার আশায় একে অপরকে সেহেরি ও ইফতার করায় এবং অভাবীকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে । এতে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত ও শক্তিশালী হয় । সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ও সাওমের সামাজিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমাদের সাওম পালন করা উচিত । আমরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতারসাথে সাওম পালন করব ।


সাওম বা রোযা ফরজ হওয়ার শর্তসমূহঃ 

  • মুসলিম হতে হবে। অমুসলিমদের জন্য রোযার বিধান প্রযোজ্য নয়। 
  • প্রাপ্ত বয়ষ্ক / নাবালেগ হতে হবে। অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য রোযা ফরজ নয়। 
  • জ্ঞান, বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। পাগল বা মস্তিষ্কবিকৃত মানুষের উপর রোযা ফরজ নয়। 
  • নারীদের ক্ষেত্রে - হায়েয / মাসিক হতে। এবং পবিত্র থাকা নিফাস/ সন্তান জন্মদানের পরবর্তী থেকে। তবে এই সময় যে সমস্থ রোযা বাদ যাবে তা যেন তারা পরবর্তী রমজানের পূর্বেই আদায় করে নেয়। 
  • রোজা পালনে সামর্থবান হওয়া। যেমন কোন মুমূর্ষ ও বিছানাগত ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। 
  • মুসাফিরের জন্য রোজা ফরয নয়। 

  • Share:

You Might Also Like

0 মন্তব্য বা কমেন্টস